শবে বরাত। ইসলাম ধর্মের অতিব গুরত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। শাবান মাসের ১৪ তারিখ রাত্রিকে হাদীসের পরিভাষায় ‘লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান’ বলা হয় আর ফারসিতে ‘শবে বরাত’ বলা হয়ে থাকে। মূলত উপমহাদেশে বহুকাল ইসলামি বিষয়াদি ফারসি ভাষায় চর্চা করা হত, যার কারণে ফারসি এ শব্দটি প্রসিদ্ধ লাভ করে। বহুল প্রচলিত ‘নামাজ’ ও ‘রোজা’ শব্দদ্বয়ও ফারসি। আমাদের সমাজে ‘মুনাফিক’ শব্দটি সচরাচর ব্যবহার হয়ে থাকে, অথচ এটা আরবি শব্দ। সব মিলে কথা হল ইসলাম যা বুঝাতে চেয়েছে আমরা তা বোঝাতে পারলেই হল।
আল্লাহ তা’আলা বলেছেন-“হা-মীম”। সুস্পষ্ট কিতাবের কসম। নিশ্চয় আমি এটি অবতরণ করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমোধিত হয়” (সূরা দুখান ১-৪)। উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রসিদ্ধ মুফাসসীর তাবেয়ী হযরত ইকরামা (রাদিআল্লাহু আনহু) বলেন- ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ দ্বারা ‘লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান’ তথা ‘শবে বরাত’ কে বোঝানো হয়েছে।
প্রসিদ্ধ সাহাবি হযরত মুয়াজ বিন জাবাল (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন- “আল্লাহ তা’আলা তার সৃষ্টি জগতের প্রতি ‘লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান’ তথা ‘শবে বরাত’ রাত্রিতে বিশেষ দৃষ্টি দান করেন এবং শিরককারী ও হিংসা পোষণকারী ব্যতীত সকলকে ক্ষমা করে দেন (সহি ইবনে হিব্বান, শুয়াবুল ঈমানসহ অসংখ্য হাদীসের কিতাবে হাদিসটি এসেছে)।
পবিত্র এ রজনীতে আমাদের কার্যসূচি স্বয়ং রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তৈরি করে দিয়েছেন। হযরত আলী (রাদিআল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন- “যখন শাবানের মধ্যবর্তী রাত তথা শবে বরাত আসবে তখন তোমরা ঐ রাত জেগে ইবাদত কর এবং দিনে রোজা রাখ” (সুনানে ইবনে মাজাহ, শাবানের মধ্যবর্তী রাত্রি পরিচ্ছেদ, হাদীস নং ১৩৮৮)।
হযরত আয়েশা (রাদিআল্লাহু আনহা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- এক রাতে আমি নবীজীকে হারিয়ে ফেললাম (বিছানায় পেলাম না), আমি নবীজীকে খুঁজতে লাগলাম। পরিশেষে জান্নাতুল বাকী শরীফে পেয়ে গেলাম। রাসুলুল্লাহ আকাশের দিকে তাকিয়ে যেন আল্লাহ তা’আলাকে ডাকছেন। নবীজী আমাকে দেখে বললেন, হে আয়েশা, তুমি কি ভয় পেয়েছো? হযরত আয়েশা বলেন, সেই ভয় আমার নেই। কিন্তু আমি ধারণা করেছি আপনি অন্য বিবিজানদের ঘরে তাশরীফ রেখেছেন। তারপর রাসুল বলেন, হে আয়েশা এ রাত ‘লাইলাতুন নিসফে মিন শাবান’। এ রাতে আল্লাহ প্রথম আসমানে অবতরণ করেন (তার শান অনুযায়ী), তিনি বনি কালব (মদিনার একটি গোত্রের নাম) এর মেষের যত লোম রয়েছে, তত পরিমাণ বান্দার গুনাহ মাফ করে দেন (তিরমিজী, শাবানের মধ্যবর্তী রাত্রি পরিচ্ছেদ, হাদীস নং ৭৩৮)।
উপরের দু’টি হাদীসের আলোকে এবং সালফে সালেহীনগণের মতামত অনুযায়ী আমরা শবে বরাতের রাতে নিম্ন আমলসমূহ করতে পারি-
(১) এশারের নামাজ জামাতের সাথে আদায় করা।
(২) কবর জেয়ারত করা (পিতা-মাতা ও আত্মীয়-স্বজন, পরিচিত-অপরিচিত)।
(৩) কুরআন তিলাওয়াত করা।
(৪) দুরূদ শরীফ পাঠ করা।
(৫) নফল নামাজ আদায় করা। (সালাতুত তাজবীহ আদায় করতে পারলে অধিক উত্তম)।
(৬) জিকির-আজকার করা।
(৭) আত্মীয়-স্বজন ও গরীব-মিসকিনদের মধ্যে খাদ্য বিতরণ করা।
(৮) তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করা।
(৯) পরের দিন রোজা রাখা।
আমাদের সমাজে পবিত্র শবে বরাতের মাহাত্ম না জানা ও না বোঝার কারণে কেউ কেউ এ রাত্রিতে আতশবাজি ফুটান, দলবেধে ট্রাক-বাস বা যানবাহনের মাধ্যমে ঘোরাঘুরি করে সময় কাটিয়ে থাকেন, যা অনুচিত। সমাজপতি ও মসজিদের সম্মানিত ইমানগণের দায়িত্ব এ ধরনের অমূলক কাজ যারা করেন তাদেরকে বোঝানো ও সর্তক করা।
শবে বরাতের রাত আল্লাহর রহমত প্রাপ্তির রাত, দোয়া কবুলের রাত, মুক্তি ও নাজাতের রাত। আমাদের উচিত এ রাতকে আমলের মাধ্যমে কাটানো। আল্লাহ সুবহানুহু ওয়া তা’আলা আমাদের সকলকে পবিত্র এ রজনীতে নেক আমল করার তাওফিক দিন ও আমাদের সমুদয় গুনাহ মাফ করুন, আমিন।